Date: April 25, 2024

দৈনিক বজ্রশক্তি

Header
collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / বাড়াবাড়ির এক দৃষ্টান্ত ইরান

বাড়াবাড়ির এক দৃষ্টান্ত ইরান

December 05, 2022 04:11:22 PM   বিশেষ নিবন্ধ
বাড়াবাড়ির এক দৃষ্টান্ত ইরান

শামীমা আক্তার:
ইসলামি বিপ্লবের চার বছর পরে ১৯৮৩ সালে ইরানে হিজাব সংক্রান্ত আইন চালু করা হয়। তখন থেকেই প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে মাথা ঢেকে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। এই বিধিগুলো তদারক করার জন্য রয়েছে দেশটির ‘নৈতিকতাবিষয়ক’ পুলিশ। দীর্ঘদিন এই আইন মেনে চললেও, গত ১৬ সেপ্টেম্বের মাহসা আমিনি নামে এক কুর্দি তরুণীর হিজাব আইনে গ্রেপ্তারের পরে মৃত্যুর ঘটনায় ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় যা এখনও চলমান (এএফপি)।
গত শনিবার (৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক বিবৃতিতে, ইরানের একটি নিরাপত্তা সংস্থা দেশজুড়ে বিক্ষোভের জেরে গত সেপ্টেম্বর থেকে ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে (রয়টার্স)। ইরানের ইসলামি রেভুল্যশনারি গার্ডের শীর্ষ জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ বলেছেন, সম্প্রতি দাঙ্গায় ৩০০ জন ‘শহীদ ও নিহত’ হয়েছে। তবে বিদেশি মানবাধিকারভিত্তিক সংগঠনের হিসাবে নিহতের সংখ্যা চারশর বেশি। এছাড়া শুধু গত সপ্তাহে শিশুসহ কমপক্ষে ১৪ হাজার মানুষ বিক্ষোভের জেরে গ্রেপ্তার হয়েছে।
অন্যদিকে ইরানের বার্তা সংস্থা মেহরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে অবস্থিত কোম প্রদেশের এক ব্যাংক ম্যানেজার বৃহস্পতিবার হিজাব না পরা এক নারীকে ব্যাংক সেবা দেন। পরে ওই ব্যাংক ম্যানেজারকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানায় কোম প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর আহমাদ হাজিজাদেহ।
ইসলামের পর্দা সংক্রান্ত বিধান নিয়ে বাড়াবাড়ি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে র্দীঘদিনের। কিন্তু একটি বিধানের জের ধরে কেন এত সহিংসতা? ইসলামে কি সত্যিই এমন কোনো বিধান আছে যা মানুষের মনে এত রোষানল তৈরি করতে পারে?
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থই শান্তি, নিরাপত্তা ও সুবিচার। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মুসলিম ভারসাম্যপূর্ণ জাতি। ইসলামের সামগ্রিক জীবন ভারসাম্যনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম গোঁড়ামি, চরমপন্থা, প্রান্তিকতা, একপেশে নীতি বা একদেশদর্শিতার নীতিকে অনুমোদন দেয় না। ফলে ইসলামের কোথাও বৈসাদৃশ্য কোনো কিছুই খোঁজে পাওয়া যায় না। আর জটিলতা যদি কিছু থেকেই থাকে, সেটা মানুষেরই তৈরি। আল¬াহ তায়ালা বলেন, ‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যমপন্থী উম্মতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর সাক্ষী হতে পারো এবং রসুলের হতে পারেন তোমাদের ওপর সাক্ষী (সূরা বাকারা ১৪৩)।’ এমনকি আল্লাহ দীনে নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ করেছেন (সুরা আন নিসা ১৭১, সুরা আল মায়েদা ৭৭)। শুধু তাই নয়, দীনের বিষয়ে কাউকে জোরজবরদস্তি করাও নিষিদ্ধ, লা ইকরাহা ফিদ্দিন (সুরা বাকারা ২৫৬)।
এই প্রাকৃতিক দীনটি পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উম্মতে মোহাম্মদি জাতি জীবনের সর্বস্ব কোরবান করেছিলেন। এমনকি সশস্ত্র সংগ্রামে মুসলিম নারীদের ভূমিকাও ছিল অতুলনীয়। উম্মতে মোহাম্মদির দুর্র্ধষ যোদ্ধা নারীদের কথা স্মরণ করতে গেলে মনে পড়ে যায়, দীন প্রতিষ্ঠার জন্য আম্মা আয়েশা (রা.) ও উম্মে সালমার (রা.) ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ; মহানবীর (সা.) ফুফু সুফিয়া বিনতে আবদিল মুত্তালিব (রা.) খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ; উম্মুল খায়ের, জুরকা বিনতে আদি, ইকরামা বিনতে আতরাশ ও উম্মে সিনান অসংখ্য যুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক কাজে সহযোগিতার কথা। মনে পড়ে যায় কীভাবে আজরা বিনতে হারিস বিন কালদা সেনাদলের নেতৃত্ব প্রদান ও আহলে বিসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, উম্মে আম্মারা (রা.) ওহুদের যুদ্ধে কীভাবে মহানবীর (সা.) জীবন রক্ষায় প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছিলেন, খাওলা (রা.) কীভাবে তাবুর খুঁটি নিয়েই রোমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই ইতিহাস।  
অথচ আজ সেই মুসলিম নারীদের মধ্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। দীনের নামে যে বিধান তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে তারা রাজপথে নেমে এসেছেন। তাহলে এটা কোন ইসলাম? আল¬াহর রসুলের আনীত দীন প্রতিষ্ঠার জন্য নারীরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন আর আজ ইরানের নারীরা সেই দীনের বিধানই অস্বীকার করে রক্ত ঝড়াচ্ছেন। তাহলে এটা কি আল¬াহর রচিত বিধান হতে পারে? এটা কি ভারসাম্যপূর্ণ দীন হতে পারে? পর্দার নামে বাড়াবাড়ি করে তৈরিকৃত বিধান আবার জোরজবরদস্তি করে নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কোন ইসলাম? না, এটা আল¬াহর রসুলের ইসলাম হতে পারে না। প্রথমত, দীনে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, দীনের বিষয়ে কাউকে জোরজবরদস্তি করা নিষিদ্ধ। ইরানের ঠিক এমনটাই ঘটেছে। আল¬াহ তাঁর রসুলকে বলছেন, ‘মো’মেন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনঅঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে (সুরা নূর ৩১)। এই সহজ সরল বিধানটি বিকৃত করে, বাড়াবাড়ি করে ভারসাম্যহীন করে ফেলা হয়েছে। পর্দার নামে নারীদেরকে বাক্সবন্দি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মনগড়া বিধান নারীদের উপর জোরজবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দীনের মধ্যে যখন বিকৃতি ঢুকে যায় তখন স্বাভাবিকভাবে সেটা মানুষকে আর শান্তি দিতে পারে না, উল্টো বিষক্রিয়া শুরু হয়। ভেতরে ভেতরে দীনের ওপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যায়। মানুষ ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে উঠে। আর প্রকৃতিগতভাবেই একদিন মানুষ সেই বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়, হারিয়ে যায় অগণিত প্রাণ।